পার্বত্য বাংগালীরা, শিক্ষা, চাকরি, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে! পরিত্রাণ কি?

0

মোঃ সোহেল রিগ্যান, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক লেখক ও ব্লগার

পার্বত্য বাংগালীরা শিক্ষা, চাকরি, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়েছে, এর থেকে পরিক্রাণ পেতে সংক্ষিপ্তভাবে কারণ গুলো চিহ্নিত করে যথাযথ দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে।

পার্বত্য বাংগালী জনগোষ্ঠী পিছিয়ে কেন? এমন প্রশ্ন অনেকেই করেন! এটা শুনতে শুনতে অনেক সময় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, এ সমস্যা সমাধানে যথাযথ কার্যকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি রাষ্ট্রের তরফ থেকে। এ নিয়ে বৈষম্যও যুক্ত হয়েছে চরমভাবে। মূলত এ কারণে অনির্দিষ্টকাল ধরে পার্বত্য বাংগালীরা সর্বদিকে পিছিয়ে আছেন। চরম বাস্তবতার নিরিখে বলতে গেলে শুধু অধিকার থেকে পিছিয়ে নয় সর্বদিকে পিছিয়ে আছে। এ পিছিয়ে থাকার কারণেই বৈষম্যমূলক আচরণেরও শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বাংগালীরা পিছিয়ে পড়ার ৫ টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে প্রতিবেদনে। প্রথমেই আলোচনা করবো বাংগালীরা শিক্ষা, চাকরি, সংস্কৃতি, আর্থ- সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার কারণ নিয়ে। পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর বাংগালীরা যাতে কিছুটা হলেও অগ্রসর হতে পারে সে লক্ষ্যে কিছু প্রস্তাবনা নিম্নে উল্লেখ করা হলো প্রতিবেদনে।

পার্বত্যাঞ্চলে সরকারের যুগোপযোগী সিদ্ধান্তে বর্তমান অনেকটাই উন্নত জীবনযাপন করছে এখানকার উপজাতীয় সম্প্রদায়ের লোকেরা। এটা যেমন সুখময় তেমনই দুঃখময়। অত্যান্ত দুঃখজনক খবর যে, বারবার এ অঞ্চলের সবকিছুতে একটি গোষ্ঠীকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে রাষ্ট্রের মূল বাংগালী জনগোষ্ঠীকে নাগরিক ও মৌলিক অধিকার হতে বঞ্চিত করা হয়েছে! একটি জাতি গোষ্ঠীকে বাড়তি সুবিধা দিতে গিয়ে আরেকটি জাতির মৌলিক অধিকার হরণ করা আইনগত অপরাধ। বলাবাহুল্য, পার্বত্য চুক্তি যেহেতু সমতার ভিত্তিতে হয়নি সেহেতু নিঃসন্দেহে এ অঞ্চলের বাংগালীরা সরকারের অনেক সুযোগ-সুবিধা হতে বঞ্চিত হয়েছে৷

১৯৯৭-২- রা ডিসেম্বরের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে উপজাতি কোটা পিছিয়ে পড়া উপজাতি জনগোষ্ঠীর জীবন মানন্নোয়নে অংশ হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। যার ফলে উপজাতি জনগোষ্ঠী অনেকটাই চালকের আসনে পৌছে গিয়েছে। সরকার যদিও এ চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ের শান্তি স্থিতিশীল সৃষ্টির লক্ষ্যে উপজাতীয় জনগোষ্ঠীক প্রাধান্য দিয়েছে, তা কালক্ষেপণ ছাড়াই বলা যায়। বলাবাহুল্য যে, চুক্তির বিষয়টি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত হিসেবে সকলেই অনিচ্ছার স্বত্বেও মেনে নিতে হচ্ছে! চুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামের তৎকালীন চলমান সংঘাত বন্ধ করণে অত্যন্ত কার্যকারী ছিলো এটাও যৌক্তিক। প্রশ্ন হচ্ছে, চুক্তির সে কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা ও সুবাতাস কী বইছে পাহাড়ে? অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি, রক্তাক্ত পাহাড় এখনো পূর্বেকার ন্যায় নয় কী?
যাক সেই সব বিষয় আর টানছি না প্রসঙ্গত কারণে। তাছাড়া প্রতিবদনের তথ্য উৎপাতের প্রয়োজনে প্রসঙ্গটি পুনরায় নিম্নে উল্লেখ করা হবে। শুধুমাত্র বৈষম্য সৃষ্টির দিকগুলো এবং পিছিয়ে পড়া হতদরিদ্র বাংগালীকে কিছুটা অগ্রসর করার কিছু বিষয় প্রতিবেদনে নিয়ে আসছি সংক্ষিপ্ততভাবে।

উপজাতি জনগোষ্ঠী এগিয়ে যাওয়ার পেছনের কারণ গুলো–

শিক্ষা, সংস্কৃতি, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উপজাতি জনগোষ্ঠীর ছেলে-মেয়েরা শিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে ও উপজাতি কোটার চাকরি সুবাদে এগিয়ে গেছে। উপজাতিদের মধ্যে যারা পিছিয়ে পরেছে তাদের জীবনমান পরিবর্তনে অপরিসীম ভূমিকা রেখে চলেছে রাষ্ট্র ও তাদের নেতৃত্বশ্রেণী।

এই অঞ্চলে বসবাসরত বাংগালীরা সমতার ভিত্তিতে রাষ্ট্র থেকে কোনকিছুই পায়নি। এটা যেমন আশ্চর্যের বিষয়, তেমনই বাস্তবত। যার প্রেক্ষিতে এখানকার বাংগালীরা শিক্ষা-চাকরি, সংস্কৃতি, আর্থ- সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে। এই চরম দুঃখ- দুর্দশা পার্বত্য বাংগালীকে যেমনটা অস্তিত্বহীন করেছে তেমনই বিস্ময়করভাবে সংকটপূর্ণ করে মেরুদণ্ডহীন করেছে। হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পার্বত্য বাংগালীরা দিশেহারা!

বাংগালীর করুণ পরিণতির বিষয়গুলো হতে পাঁচটি যথা কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে–

প্রথম কারণ– এ অঞ্চলের উপজাতি জনগোষ্ঠী, এবং বাংগালী জনগোষ্ঠীর নাগরিক মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণ কিন্তু সমতার ভিত্তিতে হয়নি কোনক্রমেই৷ চুক্তিতে যেমনটি হয়নি তেমনটি রাষ্ট্রের বিভিন্ন নাগরিক অধিকার নিশ্চিতকরণ পদক্ষেপেও হয়নি! জাতি হিসেবে পার্বত্য বাংগালীকে এখানে চরমভাবে অবজ্ঞা করা হয়েছে। ‘প্রতিবেশী রাষ্ট্র’ বাংলার স্বাধীন ভূখণ্ডে শিকড় গেড়ে বসেছে কতিপয় উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের মাধ্যমেই। এই চরম সত্য বাণী অনেকের নিকট অবিশ্বাস্য হতে পারে।

দ্বিতীয় কারণ– পার্বত্য বাংগালীদের ১৯৭৯ হতে ১৯৮৪ সনের মধ্যে সরকার কর্তৃক দেওয়া ৩/৫ একর ভূমি এখনো নিজেদের দখলে নিতে পারেনি পার্বত্য বাঙ্গালীরা! রাষ্ট্র যথার্থ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি বাংগালী জনগোষ্ঠীর। এখানে উল্লেখ যে, রাষ্ট্র তার নাগরিককে অধিকার নিশ্চিতকরণে সুরক্ষা মূলক নীতি গ্রহণ করা কর্তব্য। এ পদক্ষেপ গ্রহণকে কেউ দ্বিমত পোষণ বা জাতিগত বিভেদ উপলব্ধি ভেবে রাষ্ট্রীয় নীল নকশা যারা অনুভাব করবেই তারা মানুষ হিসেবে এখনো যথেষ্ট নয়। তাদের অন্তরে এখনো সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প রয়েছে, এরাই উগ্রবাদী ও দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক। মুখে সম্প্রীতির বুলি থাকলেও এদের অন্তরে চরম সাম্প্রদায়িকতা লালন। বাংগালীদের রেকর্ডীয় ভূমি ‘বৃটিশ প্রণীত মৃত্যু আইন পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি’ (উপজাতীয়দের প্রথাগত প্রচলিত আইন এ) দখলেই। দেশের প্রচলিত ভূমি আইনের তোয়াক্কা না করায় জটিলতা তীব্র হয়েছে। উপজাতি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বাধার ফলে বাংগালীরা নিজেদের ভূমিতে যেতে বারবার বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। গুচ্ছগ্রামের বন্দিশালায় বছরের পর বছর মানবেতর জীবনযাপন করছে হাজার হাজার বাংগালী। পার্বত্যাঞ্চলে জনসংখ্যার অনুপাতে উপজাতি-বাংগালী প্রায়ই সমান। তবুও সুযোগ-সুবিধার দিক দিয়ে একপেশে সব উপজাতীয়দের প্রাধান্য নিশ্চিতকরণ হয়েছে। অনগ্রসর ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে শুধু নয়, মানুষ হিসেবেও অন্য সবার মত তাদেরও নাগরিক-মৌলিক অধিকার অবশ্যই রয়েছে। সব বিবেচনায় তাদেরকে বাড়তি সুযোগ সুবিধা দেওয়া রাষ্ট্রের নৈতিক দ্বায়িত্ব। এটা নিয়ে কারোরই দ্বিমত পোষণ ও আপত্তি তোলা একপ্রকার অজ্ঞতা ও অনভিপ্রেত। কিন্তু দ্বিমত ও চরম আপত্তিটা বেধেছে এখানে ‘বেপরোয়াভাবে সংবিধান লংঘন পূর্বক উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর অধিকার যেভাবে সরকার দিয়েছে’ তা রাষ্ট্রের বাকী জনগণের নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে পার্বত্য বাংগালী ও উপজাতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিশাল তফাৎ সৃষ্টি হয়। এ তফাৎ অনেক সময় চরম সংঘাতের রুপ নেয়। পাহাড়ের প্রকৃত বাস্তবতা না জেনে যারা ঢাকা-চট্টগ্রাম বসে সরগরম করে তারা বর্ণচোরা, কথিত সুশীল, এবং জ্ঞানপাপী ও বুদ্ধি ব্যবসায়ী।
সরকার তৎকালীন সন্ত্রাসীদের আক্রমণ হতে রক্ষা করার তাগিদে দ্রুততার সাথে যে, গুচ্ছগ্রাম সৃষ্টি করেছে, সেসব গুচ্ছগ্রাম গুলো নূন্যতম মানুষ বসবাসের উপযোগী নয়। ১০০/২০০ পরিবারের গুচ্ছ গ্রামে এখন হাজার হাজার বাংগালী বসবাস করে আসছে৷ দিনমজুর, হতদরিদ্র, নিপীড়ন-নির্যাতিত ও শোষিত বাংগালীদের তিন বেলা খাওয়ার জুটে না সময় সময়েই৷ গোয়াল ঘরের মধ্যে বসবাস করে দিন অতিবাহিত করতে হয় জীবনের নিয়মে। পার্বত্য চট্টগ্রামের নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও প্রকৃতির নিদর্শন পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংগালীর জন্য এক অভিশপ্ত অঞ্চল বলা যায়। তবুও দেশপ্রেম ও দেশের মাটিকে ছায়াতল ভেবে পার্বত্য মাটিকে রক্ষার দাগিতে নিজের সবকিছু বির্সজন দিয়ে বছরের পর বছর রাষ্ট্রের অবহেলার শিকার হচ্ছে পার্বত্য বাংগালীরা। গুচ্ছগ্রাম গুলোর অবস্থা স্বচোখে প্রত্যক্ষ না করলে অনুমেয় হবে না এর বাস্তবতা। পানির তীব্র সংকট রয়েছে গুচ্ছগ্রাম গুলোতে। সরকার নাগরিক সুবিধার্থে নেওয়া পদক্ষেপ গুলো হতে গুচ্ছগ্রামের বাংগালীরা প্রায়ই বঞ্চিত। সরকারী পর্যাপ্ত সহযোগীতা অদৃশ্য শক্তির ইন্ধনে পৌছায় না গুচ্ছগ্রাম গুলোতে। শৌচাগার গুলোর দুর্গন্ধ, পানি ও বর্জ পরিহার করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় এখানকার বাংগালী শিশুরা নানান রোগবালাই আক্রান্ত হয়। পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে অনেক শিশু শারীরিক মানসিক বিকাশের বাধাগ্রস্ত হয়। চুক্তির অনুযায়ী এখানকার ৯০% এর অধিক সুযোগ-সুবিধা উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ। অবশিষ্ট ১০% সুযোগ-সুবিধাও বাংগালীদের প্রদান করা হয়না! পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এর বরাদ্দ ও প্রকল্প বাংগালীদের জন্য নয়। এ অঞ্চলের স্বায়িত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোও অনগ্রসর উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর জীবনমান, শিক্ষা-দীক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশ অগ্রসর করে যেমনটা ভূমিকা রাখছে, তেমনটা বাংগালীদের বেলায় রাখছেন না। তারা এখানে বরং বাংগালীদের দমিয়ে রাখার নীল নকশা বাস্তবায়নে সবচেয়ে বেশিই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে! বলাবাহুল্য, অর্থনীতিক চালিকাশক্তি বৃদ্ধির নিমিত্তে নানান কর্মমুখী জনবান্ধন প্রকল্প বরাদ্দ দেন পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়। এসমস্ত প্রকল্পগুলো বন্টন করে বাস্তবায়নের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডকে দেওয়া হয়। জনবান্ধব প্রকল্প বন্টন করার গুরুত্বপূর্ণ অগ্রণী ভূমিকা রাখছে চুক্তির শর্ত অনুসারে উপজাতীয়দের হাতে থাকা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো। উপজাতি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে এর ক্ষমতা থাকার ফলে প্রাপ্য অধিকার হতে বাংগালীরা বঞ্চিত হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে কাজ করা দাতাসংস্থা, মিশনারি ও এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলো উপজাতীয়দের অর্থনীতি সচ্ছল, শিক্ষা নিশ্চিতকরণসহ উন্নত জীবনযাপনে সহযোগিতা প্রদান করে আসছে। তবে উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর অধিকারের দোহাই দিয়ে গর্জে উঠা সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, খুন-গুম ও আধিপত্য বিস্তার করার পাশাপাশি বন্দুকের নল দেখিয়ে উপজাতীয় সম্প্রদায়ের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের একতৃতীয়াংশ লুটপাট করে খাচ্ছে। সমতলের অনেকেই মায়াকান্না করে অভিযোগ করছে, উপজাতিরা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না। অথচ সরকার সবকিছু ঠিকই দিচ্ছে। এখানে তাদের না পাওয়া নিয়ে দায় তো পার্বত্য বাংগালী তথা রাষ্ট্রের নয়। রাষ্ট্র দিচ্ছে তা চুষে খাচ্ছে তাদেরই কর্ণাধার পরিচয়দানকারীরা। উপজাতিরা যেসমস্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন, তার ৫% ও যদি এখানকার বাংগালীরা ভোগ করতেন তাহলে বাংগালীদের চরম দুঃখ দুর্দশ হয়তো কিছুটা হলেও অবসান হতোই।

তৃতীয় কারণ– গুচ্ছগ্রামে বাংগালী পরিবারগুলোর অর্থনীতিক চালিকা শক্তির মূল উৎস পাহাড় হতে ‘লাকড়ি সংগ্রহ’! একটি জাতির জীবিকা ও অর্থনীতির প্রধান কর্মব্যবস্থা যদি ‘লাকড়ি সংগ্রহ হয়’ সে জাতি কতটাই নির্যাতন-নিপীড়ন, শাসন-শোষণের শিকার তা বলে বুঝানো কষ্টসাধ্য। মাইলকে মাইল পাহাড় পাড়ি দিয়ে লাকড়ি সংগ্রহ করে বাংগালী নারীরা সে লাকড়ি বাজারে বিক্রি করে পরিবার পরিজন নিয়ে কোনমতে দিনযাপন করে৷ এই কঠিন বাস্তব চিত্র কী মানবতারফেরি করা প্রগতিশীল, সুশীল ও তথাকথিত সংবাদমাধ্যম কানে পৌঁছে? পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এই কঠিন বাস্তব চিত্র কিন্তু পার্বত্য সংসদীয় আসন গুলোর সংসদ সদস্যরাও স্বীকার করেনা! এমনকি বাংগালীর চরম দুঃখ- দুদর্শার কথা সংসদ অধিবেশনেও তারা বলে না! অথচ তারা বাংগালীর ভোটে নির্বাচিত হয়। সর্বদিক থেকে যদি বাংগালীর লাগাম টেনে ধরা হয়, কোন পথে পার্বত্য বাংগালীর ভবিষ্যত? এমন হাল যদি বাংগালীদের হয় কীভাবে বাংগালীরা তাদের সন্তানাদি নামি-দামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করাবেন? আর কীভাবে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এগিয়ে নিবেন? যেখানে বেছে থাকার তাগিদে খাদ্য নিয়ে সংগ্রাম সেখানে শিক্ষা গ্রহণ অকল্পনীয় স্বপ্ন নয় কী? বাংগালী ছেলে-মেয়েদের সমবয়সী উপজাতি ছেলে-মেয়েরা শিক্ষাবৃত্তি, কোটায় সুবিধা পেয়ে ধাপে ধাপেই লক্ষ্যমাত্রা চুড়ান্ত করে। সেখানে বাংগালী ছেলে-মেয়েরা বৈষম্যের শিকার হয়! এসএসসি গন্ডি পেরোতে বাংগালী ছেলে-মেয়েদের পিতা-মাতার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়, কী করে আবার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখবে? কিছু সংখ্যক বাংগালী একটি গোষ্ঠীর তাবেদারী ইজারা নিয়ে তারা ভালো অবস্থানে আছে। তাদের অবস্থানে সমগ্র পার্বত্য বাংগালীকে বিবেচনা করলে বাংগালীকে দমিয়ে রাখার আরেকটি পন্থা চর্চা করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।

চতুর্থ কারণ– পাহাড়ে বাংগালী সংস্কৃতি বিকাশ না হওয়ার পেছনে মূল কারণ গুলোর অন্যতম যে, কারণ প্রতিয়মান হয় সেটা হলো এখানকার অধিকাংশ বাংগালীরা বাস্তুহারা, গুচ্ছগ্রামের বন্দী শিবিররই তাদের শেষ সম্বল। দেশের সব জনগণের ৫টি মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে সংবিধান রাষ্ট্রের প্রতি তাগিদ দিয়েছেন, ১. খাদ্য, ২. বস্ত্র, ৩. বাসস্থান, ৪. চিকিৎসা ও ৫. শিক্ষা। যেখানে পার্বত্য বাংগালীদের বাসস্থান নেই সেখানে কীভাবে সংস্কৃতি বিকাশের মত বিলাসী ভাবনা আসবে? আগে মৌলিক চাহিদা রাষ্ট্র মিটিয়ে দিক তার পরে সংস্কৃতি চর্চার বিকাশ ঘটবে।

পঞ্চম কারণ– রাজনীতিতে এখানকার গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবী গুলো উপজাতি নেতৃত্ব শ্রেণীর দখলে।
জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক দলগুলো বিদেশী প্রভুদের খুশি রাখতে পার্বত্য সংসদীয় আসন গুলোর নমিনেশন উপজাতীয় নেতৃত্ববৃন্দর হাতে তুলে দেন। জেলা ও উপজেলা কমিটির পদ-পদবীতে বাংগালীদের রাখা হয় দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক মর্যাদায়। পার্বত্য বাংগালীর জন্য এর থেকে বড় লজ্জা আর কী হতে পারে? বাংগালীদের মধ্যে নেতৃত্বহীনতা সমস্যা প্রকট। এবং নেতৃত্ব নিয়েই বিভাজন সৃষ্টি হয় বেশি। এক বাংগালী আরেক বাংগালীর পেছনে লেগে থাকাতেই অস্বাভাবিক মাত্রাই বাংগালী ‘নেতৃত্ব সংকট’ ঘনীভুত হচ্ছে। সঠিক যোগ্য নেতৃত্ব বাংগালীদের মধ্যে তৈরি না হওয়াই ‘সুযোগ-সন্ধানী, দলকানা ও অকৃতজ্ঞ বাংগালীরা’ উপজাতীয় নেতাদের তোষামোদ করে নিজেদের ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা আদায় করে জাতির অধিকারের কথা কর্ণপাত করতে স্বদিচ্ছা হারিয়ে ফেলে। পার্বত্য বাংগালী নেতৃত্ব সৃষ্টি না হওয়ার পেছনে সবচেয়ে নিখুঁত কারণ অদৃশ্য শক্তির পরোক্ষ ইন্ধন। এবং বাংগালী আন্দোলন ধ্বংস। এখানকার বাংগালী সম্প্রদায়কে দমিয়ে রাখার সেই কৌশল-কূটচাল অবলম্বন ও ষড়যন্ত্র চুক্তির পরপর সময় হতে শুরু হয়েছে৷ শিক্ষা ও আর্থ -সামাজিক অবস্থান তীব্র সংকটে থাকায় বাংগালীরা নেতৃত্বের সিংহভাগই আসন দখল করতে বর্থ্য হচ্ছে। চাটুকারিতা যখন বাংগালীর প্রধান পেশা হয় তখন জাত বিক্রি করে দেওয়া আর কী বা অপরাধ? বাঙ্গালীকে দমিয়ে রাখতে, বাংগালী নেতৃত্ববৃন্দ যারা আছেন, তাদেরকে কিছু টাকাও ব্যবসায়ীক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে একাধিক গ্রুপ সৃষ্টি করে দেওয়া হয়! সন্ত্রাসীদের দালালী ও চাটুকারিতার জন্যেও ভালো একটা মাসোহারা দেওয়া হয়! পাহাড়ের বাংগালীদের মধ্যে কিছু অংশ বর্তমানে উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের রাষ্ট্র বিরোধী তৎপরতার কাজে নিয়োজিত। কোন বাংগালী যুবক বা প্রবীণ যখন বাংগালী নেতৃত্ব বিকাশে ভূমিকা রাখবে ঠিক তখনই তাকে মামলা-হামলা কিংবা সামাজিক বয়কট সৃষ্টি করে হেয় প্রতিপন্ন পূর্বক তার অস্তিত্ব বিলিন করবেই। পার্বত্য বাংগালীরা পিছিয়ে যাওয়ার পেছনে এই বিষয়গুলো সুক্ষভাবে জড়িত।

ইতিমধ্যেই উপজাতি-বাংগালী বৈষম্যের নমুনা সম্পর্কে জেনেছেন। পার্বত্য চুক্তির পক্ষপাত এমন হাল উপজাতীয়রা অগ্রসর হলেও বাংগালী একদম সর্বদিকে তলানিতে। চুক্তির সংবিধান বিরোধী ও বৈষম্যমূলক ধারা গুলো সংশোধন একমাত্র সমতা ফিরে আনতে পারে। এর বিকল্প কিছুই এখানকার বাংগালী অগ্রসর হওয়ার সুযোগই নেই।

মানবেতর জীবনযাপন করা বাঙ্গালীদের মধ্যে কর্মমুখী পরিকল্পনাই বাঙ্গালীর মুখে হাসি ফুটাতে পারে।

পার্বত্য বাঙ্গালীরা নানান ষড়যন্ত্রে জর্জরিত। এই বাঙ্গালীদের সমস্যা সমাধান এবং অধিকার নিশ্চিতে কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায় না। পাহাড় উপত্যকায় বসবাসরত বাঙ্গালীদের জীবনমান উন্নয়নে কিছু কর্মসূখী পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে, যার প্রস্তাবনা সমূহ-

১. বাংগালীদের রেকর্ডীয় জায়গাতে বাংগালীদের ফিরে যেতে উপযুক্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করা।

২.গুচ্ছগ্রাম গুলোতে পানির তীব্র সংকট সমাধানে টিউবওয়েল স্থাপন করা এবং পানি সরবরাহে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

৩.বাংগালী নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেওয়া।

৪.বাংগালীদের সুদ মুক্ত বা সহজ শর্তে এবং কম সুদে ব্যাংক থেকে ঋণ দেওয়ার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

৫.বাংগালীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন জনবান্ধব প্রকল্প বরাদ্দ দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা। প্রকল্প গুলো যেমন, বাঁধ নির্মাণ করে জলাশয় সৃষ্টি করে মৎস্য চাষ, মৌসুমে চাহিদা থাকা ফলমূল, কৃষিপণ্য, এবং বিভিন্ন খামার গড়ে তোলাসহ নানানভাবে কর্মস্থল সৃষ্টি হওয়ার মত প্রকল্প বরাদ্দ দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা।

৬.বাংগালী ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা নিশ্চিত করণে গণসচেতনতা মূলক পদক্ষেপ নেওয়া এবং তাদের শিক্ষাবৃত্তি, শিক্ষার সামগ্রী দেওয়াসহ ভালো কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেওয়া।

৭.পার্বত্য বাংগালীদের নেতৃত্ব তৈরিও সুসংগঠিত করার জন্য পার্বত্যাঞ্চলে একটি বাংগালী সম্প্রদায়ের জন্য কমপ্লেক্স স্থাপন করা। যদি উপজাতীয়দের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থাকতে পারে বাংগালীর জন্য উন্মুক্ত নামে কমপ্লেক্স স্থাপন সমস্যা কোথায়? কেন বা এতে বিপত্তি থাকবে? উল্লেখ্য যে, মন্দ লোকের মন্দা কথা সব কাজেই থাকে।

৮.পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে বাংগালী প্রেমি ব্যাক্তিদের সদস্য হওয়ার জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা। প্রয়োজনে বাংগালীর জন্য সংরক্ষিত থাকা সদস্য আসনে ‘আত্মকেন্দ্রীক, বাংগালীর অস্তিত্ব ধ্বংসকারী ও বেইমান মীরজাফর’ এর বিনাশ ঘটিয়ে জাতির স্বার্থে অগ্রণী ভূমিকা রাখা ব্যক্তিদের সদস্য করার সুযোগ সৃষ্টি করা। এবং যেসকল বাংগালীরা স্বজাতির বিরুদ্ধে কাজ করে তাদের শনাক্ত পূর্বক বয়কট বা প্রশাসনিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

৯.ইউপি নির্বাচন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সুযোগ-সন্ধানী বাংগালীর লাগাম টেনে ধরে বাংগালী প্রেমি প্রার্থী সিলেক্ট করে নির্বাচিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এতে বাংগালী নেতৃত্ব সৃষ্টি হবে এবং বাংগালীরা রাষ্ট্র হতে তার অধিকার আদায় করতে সক্ষম হবে। এ অঞ্চলে পিছিয়ে পড়া বাংগালী জনগোষ্ঠীর ন্যায় অধিকারের কথা তুলে ধরার জন্য কিছু লেখক সৃষ্টি করা, যেহেতু এখানকার গণমাধ্যমগুলো বাংগালী অধিকার বিমুখী সেহেতু পার্বত্য বাংগালীদের অধিকারের বিষয়াবলি, এবং সন্ত্রাসীদের দেশ বিরোধী অপতৎপরতা সম্পর্কে তুলে ধরার জন্য লেখক সৃষ্টি করা অত্যান্ত আবশ্যক।

১০.বাংগালীর জন্য ত্যাগ শিকার করে এমন যারা আছেন, তাদেরকে বিভিন্ন সহযোগীতামূলক কাজে দায়িত্ব দিতে হবে। এর ফলে তাদের মাধ্যমে সমবন্টন নিশ্চিত হবে। প্রয়োজনে যোগ্য মেধাসম্পূর্ণ যারা আছেন, তাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে সদস্য বা দায়িত্ব দেওয়ার মত পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

প্রস্তাবনার বিষয়বস্তু আংশিক বাস্তবায়িত হলে পার্বত্য বাংগালীর চরম দুঃখ দুর্দশা কিছুটা হলেও অবসান হবে।

বেসামরিক ও রাজনৈতিক আন্তর্জাতিক চুক্তির (আইসিসিপিয়ার) মানবাধিকার সনদ এর ১৯ নং অনুচ্ছেদ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী অভিব্যক্তির স্বাধীন প্রকাশকে শনাক্ত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে “প্রত্যেকের অধিকার আছে নিজের মতামত এবং অভিব্যক্তি প্রকাশ করার। এই অধিকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে নিজের স্বাধীনচেতায় কোনো বাধা ব্যতীত অটল থাকা।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More