মানবাধিকার কমিশনের শুনানিতে স্থানীয় অধিবাসীরা অস্ত্র ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কী বললেন?

0

 

মোঃ সোহেল রিগ্যান– জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পার্বত্য চট্টগ্রাম সফরের তৃতীয় দিন অদ্য ১৮ জানুয়ারী সকাল ১১ ঘটিকায় রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ইনস্টিটিউটে আয়োজিত গণশুনানিতে মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহম্মেদ, কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য মোঃ সেলিম রেজা এবং মোঃ আমিনুল উপস্থিতিতে শুনানিতে অংশ নিয়ে যেসব বিষয়ে বক্তব্য প্রদান করেন। সেসব বক্তব্যে উপজাতি সন্ত্রাসীদের অব্যাহত চাঁদাবাজি, খুন-গুম বিষয়ে স্থানীয় পাহাড়ি বাঙ্গালীরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

শুনানিতে অংশ নেওয়া বক্তৃতারা যা বললেন তা পাঠকদের জ্ঞাতার্থে তুলে ধরা হলো-

পরেশ মজুমদার, শ্রমিক ইউনিয়ন ও সড়ক ঐক্য পরিষদ নৌযান পরিষদ, তিনি বলেন, শ্রমিককে অপহরণ করা হচ্ছে৷ ৪জন শ্রমিককে চাঁদার জন্য অপহরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রত্ন দাশ ও জহির অন্যতম। শ্রমিক অপহরণের সঙ্গে উপজাতি সন্ত্রাসীরা জড়িত। পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত। অত্র অঞ্চলে চাঁদাবাজি ছাড়া কিছু হয়না। সন্ত্রাসীরা চাঁদার জন্য সিএনজি জ্বালিয়ে দিয়েছেন। সেনাবাহিনী ও পুলিশসহ এখানে প্রশাসন অনেক শ্রম দিয়ে যাচ্ছে এবং কষ্ট করে যাচ্ছে। আমাদের একটা গাড়ি যখন অপহরণ করা হয় তখন আমরা প্রশাসনের সহযোগীতা পায়। কিন্তু সন্ত্রাসীরা যেসব অভিযোগ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে করে তা ডাহা মিথ্যা।

শাহিদুল ইসলাম, রাজস্থলী উপজেলার বাঙ্গালহালিয়ার বাসিন্দা। তিনি পূর্বে সিএনজি ও মাহেন্দ্রা সমিতির দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তির মূল কারণ অবৈধ অস্ত্র। প্রতি জুন মাস আসলে অবৈধ অস্ত্রধারীরা আমাদের থেকে চাঁদা নেয়৷ প্রতিবছর আমরা ৫০০ জন সিএনজি চালক যা আয় করি তা সন্ত্রাসীদের চাঁদা দিয়ে দিতে হয়। ৪/৫টি সন্ত্রাসী দল রয়েছে৷ তাদের মধ্যে ভালো খারাপ আমরা চিনিনা। কিন্তু তারা সবাই চাঁদাবাজ এটা সবাই জানি।
কিছুই দিন আগে বাঙ্গালহালিয়া থেকে আমাদের আপন ছোট ভাইকে অপহরণ করা হয়েছে৷ তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি৷ আমার একটাই দাবি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার চাই।

কাজী মজিবর রহমান, পার্বত্য চট্টগ্রামে নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান। তিনি বাঙ্গালীরা বৈষম্য শিকারের কথাগুলো বলেন। ডিসিদের কার্যকারীতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। রেভিনিউ সার্কেল চীপ ও হেডম্যানকে দেওয়ার বিধান সংবিধান পরিপন্থী৷ তিন পার্বত্য জেলার এমপি, মন্ত্রী, জেলা পরিষদ ও উন্নয়ন বোর্ড ও মহিলা এমপিসহ সব পাহাড়ি। বাঙ্গালীরা এখানে কিছু পায়নি৷ শুধু বৈষম্যের শিকার হয়েছে৷ সীমান্তে ১৭৪ কিলোমিটার কাঁটাতারের বেড়া নেই৷ সেনা ক্যান্ট ও সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করা হোক এবং অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হোক তাতে আমাদের আপত্তি নেই৷

পারভেজ মোশাররফ, রাঙামাটি পাবলিক কলেজ স্টুডেন্ট। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ৬১ জেলার মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলে সবার খুশি ও গর্ববোধ করে৷ কিন্তু পাহাড়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করলে একদল তার বিরোধিতা করে। তারা এখানে উন্নয়ন চায়না। কিন্তু আবার উন্নয়ন হলে তা ভোগ করেন! কিছুদিন আগে পূর্ণিমা চাকমাকে সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছে কিন্তু তার বিচার আজো হয়নি৷ আমরা চাই পাহাড়ি-বাঙ্গালী সকলেই মিলেমিশে থাকতে৷ আমরা যখন স্কুল, কলেজে যায় তখন পাহাড়ি মেয়েদের সঙ্গে বাঙালিদের কথা বলতে দেয়না। পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা বাধাপ্রদান করে থাকে।
মানবাধিকার কমিশনের মন্তব্য, ধন্যবাদ পারভেজ তোমার বক্তব্য সুন্দর হয়েছে এ বয়সে তোমার এই বোধ ও জাগরণের জন্য।

প্রসন্ন কুমার চাকমা, তিনি পেশায় একজন শিক্ষক।
তিনি বলেন, পার্বত্য চুক্তির অংশ হিসেবে মাতৃভাষায় শিক্ষা চালু করতে দাবি জানায়। এজন্য সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসা উচিত। চুক্তিতে মাতৃভাষা শিকার কথা বলা হয়েছে।

মিজানুর রহমান বাবু, অটোরিক্সা শ্রমিক ইউনিয়ন ও চালক কল্যাণ সমিতি। তিনি বলেন, আমার প্রশ্ন আপনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ মানবাধিকার রক্ষা নিয়ে কাজ করেন। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে সবাই মিলেমিশে চলাফেরার চেষ্টা করি। বিগত ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ খ্রিঃ আমার অটোরিক্সা শ্রমিক কামাল হোসেন এর সিএনজি অটোরিক্সা কারা জ্বালিয়ে দিয়েছে? রাঙামাটি আসামবস্তি, কাপ্তাই সড়ক, মানিকছড়ি ও কতুকছড়িতে পুলিশ মুভ করতে পারেনা সন্ত্রাসীদের ভয়ে। সেখানে পুলিশ সেনাবাহিনী ছাড়া মুভ করতে পারেনা।৷ এখানে এই সন্ত্রাসীরা কারা? আমরা পহেলা বৈশাখে সম্প্রতি বজায় রেখে করি। আমরা শ্রমিকরা চাঁদার জন্য নির্যাতনের শিকার হচ্ছি। এই থেকে আমরা মুক্তি চায় সেনাবাহিনী ক্যাম্প বৃদ্ধি করা হোক।

নাসরিন ইসলাম, ভাইস চেয়ারম্যান রাঙামাটি সদর উপজেলা পরিষদ। তিনি বলেন, আমার সদর উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন, চেয়ারম্যান মেম্বার যারা আছেন তারা জানে আমাদের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাঁদা দিতে হয়। ইউনিয়ন পর্যায়ে যখন রাস্তা তৈরি করা হয় তখন সন্ত্রাসীরা ফোন করে ২ লাখ টাকা চাঁদা চায়। কিন্তু যাদের জন্য এই উন্নয়ন তাদেকে যদি চাঁদা দিতে হয় তাহলে তো দুর্ভাগ্য বলে হয় ৷ এখানে যিনি আগে মানবাধিকার সদস্য ছিলেন৷ তিনি কখনো সব প্রতিনিধির সাথে কথা বা সমস্যা জানতে চাননি। পার্বত্য সংরক্ষিত আসনের এমপি বাসন্তি চাকমা শুধুমাত্র কী পাহাড়িদের জন্য এবং খাগড়াছড়ির জন্য? তার শীতবস্ত্র বিতরণ শুধুমাত্র পাহাড়ীদের জন্য!

মোঃ ফোরকান হোসেন মুন্না রাজস্থলী উপজেলার বাসিন্দা৷ তিনি বলেন, আমার ছোটভাই ২৩ বছর বয়স। বান্দরবান পড়াশোনা করেন। আমার ভাইকে ৪৪দিন আগে জেএসএস অপহরণ করে। আমতলীপাড়া রাজস্থলী হইতে অপহরণ করেছে৷ একটা ছাত্র মানুষকে কেন যে অপহরণ করেছে তা আমার বোধ্যগম নয়। আজকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সব জায়গা থেকে হেডম্যান কার্বারী ও জনপ্রতিনিধিসহ সবাই আসছে। সন্ত্রাসীদের এই অত্যাচার কথা সবাই জানে। সবাই জানে আমার ছোটভাই নিরপরাধ এবং আমি বিশ্বাস করি আমার ভাই এখনো অক্ষত আছে৷ আমি প্রশাসনের নিকট জোর দাবি জানায় আমার ভাইকে উদ্ধারের।

থুয়োইঅং মারমা, হেডম্যান কাপ্তাই উপজেলার। তিনি বলেন, পার্বত্য এলাকায় আমরা হেডম্যানরা যে কাজ করি। সরকারের রেভিনিউ আদায় করি। আমরা সরকারের রাজস্বে আদায় ও প্রথাগত প্রতিষ্ঠান গুলোকে সহযোগিতা করি। ১৯৯৭ সালের চুক্তির পর যে আইন গুলো করেছে৷ সে আইনগুলো কার্যকর হচ্ছে না। চুক্তির আঞ্চলিক পরিষদ, ও ভূমি সমস্যা নিরসনে আইন কার্যকর করা জরুরী। জাতিসংঘের ILO বাস্তবায়ন চাই আমরা।

কাজী জালোয়া, রাঙামাটির বাসিন্দা। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ঠিকাদারি কাজে চাঁদা দিতে হয়। বিভিন্ন ফলমূল বিক্রি করলে চাঁদা দিতে হয়। আর চাঁদাবাজির বিভিন্ন খাত রয়েছে৷ চাঁদাবাজির অভয়ারণ্য হচ্ছে পার্বত্য জেলাগুলো। পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি অনুযায়ী, এখানে ভূমির মালিক তিনজন। যা আইনগতভাবে অসাংবিধানিক এবং বৈষম্য৷ বাজার ফান্ডের জায়গা নিয়ে সমস্যা। বাজার ফান্ড নিয়ে জেলা প্রশাসক ও জেলা পরিষদ ঝামেলা রয়েছে। তাই ব্যাংক ঋণ বন্ধ রয়েছে। এটার কোন সমাধান নেই! আমরা যখন হেডম্যানের কাছে যায় তখন হেডম্যানকে চাঁদা দিতে হয়। হেডম্যান এর কাছে গেলে বাঙালীরা অর্ধেক মৃত্যু যায়। বাঙ্গালী হয়রানির নাম হেডম্যান। একটি হেডম্যান রিপোর্টের জন্য বাঙালির জুতা ক্ষয় হয়ে যায়।

অংসুছাইন চৌধুরী, সভাপতি কাপ্তাই উপজেলা আওয়ামালীগ এবং সদস্য রাঙামাটি জেলা পরিষদ। তিনি বলেন,
আমার এলাকা কাপ্তাই চিৎমরম মানুষ নিজবাড়িতে থাকা দায়। আমি ১৯৮৩ সালে এসএসসি পাশ করি। আমি তখন থেকে আওয়ামালীগ এ যোগদান করি। আমি জেলা পরিষদের সদস্য আমার ভাই এলাকার জনপ্রতিনিধি চেয়ারম্যান। সেই ও আমি বাড়িতে থাকতে পারিনা সন্ত্রাসীদের হুমকির ভয়ে। আমার ইউনিয়ন নেতা হাবিবুর রহমানকে জেএসএস অপহরণ পূর্বক হত্যার চেষ্ঠা করে মৃত্যুভাবে ফেলে চলে যায়। সেদিন সে কোনভাবে বেচে যায়। জেএসএস এর চাঁদাবাজি ও অপহরণের কারণে আমরা শান্তিতে নেই৷ আমরা পাহাড়ি- বাঙালি সম্প্রীতি বজায় রাখতে বিশ্বাসী। আমি মারমা বৌদ্ধ হলেও আমিু মুসলমানদের পবিত্র ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা সময় অংশ গ্রহণ করি। হিন্দু, মুসলিম ও খ্রিস্টানরা আমাদের সংস্কৃতি ও ধর্মী অনুষ্ঠানে আসে। আমরাও যায়। আমি সরকারি কাজে রাঙামাটি জেলা পরিষদে আসতে প্রশাসনের নিরাপত্তা ছাড়া আসতে পারিনা। আমাকে প্রধানমন্ত্রী চিনেন, আমার স্ত্রীর অসুস্থ থাকার সময় প্রধানমন্ত্রীর নিজে সহযোগী করেছে। আমি চাই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। এই কথাগুলো আমি আপনার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছাতে চাই।

কাজী নজরুল ইসলাম, তিনি রাঙামাটির বাসিন্দা। তিনি বলেন, আমি ১৯৭৩থেকে ৭৭ পর্যন্ত রাঙামাটি পৌরসভার মেয়র ছিলাম। আমি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে যা বলতে চাই, আমি অনেক দিন ধরে বলতে চাই আমরা একক আইনের দেশ৷ কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে কেন এর ভিন্নতা? পার্বত্য চুক্তিতে অস্ত্র জমা দেওয়া আমি স্বচোখে দেখেছি। তখন জেএসএস বলেছিল সব অস্ত্র জমা দিবে। কিন্তু চুক্তির এতোবছর পর কেন অবৈধ অস্ত্র? সেসময় যদি ভালোভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হতো তাহলে এখন অবৈধ অস্ত্র থাকত না। পার্বত্য চুক্তিতে বলা হয়েছে এখানে ভোটার হইতে হলে এখানে বৈধ জায়গা জমির কাগজপত্র থাকতে হবে! আমি কাপ্তাই বাঁধের পূর্ব থেকে রাঙামাটি ডিসি বাংলো এলাকার বাসিন্দা৷ আমি এখানের সবকিছু জানি৷ এখানে জায়গা না থাকলে ডিসি সনদ বা বাসিন্দা সনদের জন্য মানুষ হয়রানির শিকার হতে হয়। এখানে সংবিধান লঙ্ঘন চলছে৷ 1 man 1 Vote যদি হয়। ২২ বছর ধরে জেলা পরিষদ অর্নিবাচিত প্রতিনিধি চলছে৷ যার কারণে এখানে জনগণের প্রতি প্রতিনিধিদের দায়বদ্ধতা নেই৷ তারা কেউ জনগণের কথা শুনতে ইচ্ছুক নয়।

শহীদ ইসলাম, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র। অনগ্রসর জাতি হিসেবে সরকার ১৯৮৪ সালে কোটা সুবিধা চালু করেছে৷ আমরা বাঙ্গালীরা অনগ্রসর হলেও কোটা সুবিধা পাচ্ছি না। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপজাতি কোটা রয়েছে কিন্তু বাঙালি কোটা নেই৷ পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড শিক্ষাবৃত্তির মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। ৩০ জনের মধ্যে বাঙালি ২জনও নেই৷ যদি ৩০ জনের মধ্যে ২জনও দেওয়া হতো তাহলে আমরা সন্তুষ্ট রাখতাম। কিন্তু এই বৈষম্যের অবসান কোথায়?

এভাবে পার্বত্য বাঙ্গালী ও পাহাড়িরা সন্ত্রাসী কর্তৃক চাঁদাবাজি ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঘটনার বর্ণনা গুলো দেন। কিছু উগ্রবাদী পাহাড়ি ইউপিডিএফ-জেএসএস এর এজেন্ট হিসেবে সেনাবাহিনী ও বাঙালি বিরোধী বক্তব্য দিয়েছে। যা উস্কানিমূলক এবং পাহাড়ের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট করার আভ্যাস বলা যায়।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More