পাহাড়ে নৈরাজ্য সৃষ্টির অভিযোগে কেএনএফ সন্ত্রাসীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।

0

পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি জেলার নাম বান্দরবান। সম্প্রীতির মেলবন্ধন ও পর্যটন শিল্পের এক অপার সম্ভাবনাময় এই বান্দরবান। বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী ক্ষুদ্র- নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায় ও বাঙ্গালীসহ ১১টি জাতিস্বত্বার বসবাস এই জেলায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাকী আরো ২টি জেলা রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির মত রক্তারক্তি সংঘর্ষ, হানাহানি, খুনাখুনি এবং অস্ত্র লড়াই ছিল না সম্প্রীতির বান্দরবান। হঠাৎ এই সম্প্রীতির বান্দরবান কালো মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশে বাতাসে। বম, লুসাই, খুমি, চাক ও পাংখোয়া জাতিস্বত্বার অধিকার এর দোহাই এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ৯টি উপজেলাকে পৃথক করে আলাদা একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র বা কুকিল্যান্ড বানানোর স্বপ্ন নিয়ে গড়ে তোলে সশস্ত্র গেরিলা বাহিনী। এরপর থেকে তাদের চাঁদাবাজি, অপহরণ বাণিজ্য, খুন-গুম এবং রাষ্ট্র বিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনার করার মাধ্যমে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। সম্প্রীতির বান্দরবান অশান্তির দাবানলে পুড়তে থাকে। জেলার দুর্গম রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলার সাধারণ পাহাড়ি সম্প্রদায়কে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রসারিত করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে আসছে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামের এই বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন। সংগঠনটি বিদেশী দাতা সংস্থা, এনজিও, আই এনজিও, খ্রিস্টান মিশনারি, নরওয়ে, ডেনমার্ক এর মত ষড়যন্ত্রকারী দেশের পৃষ্ঠপোষকতায় সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পৃথক করে আলাদা কুকিল্যান্ড করার রঙিন স্বপ্ন লালন করে প্রতিপক্ষ, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, খুমি, ম্রোসহ অন্যান্য জাতির উপর আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে এবং শান্তি স্থাপনে কাজ করা সেনাবাহিনীর উপর হামলা করে আসছে। তারা বাংলাদেশের মেরুদণ্ড সেনাবাহিনীর সদস্যের হত্যার মিশনে চোরাগোপ্তা হামলা পথ বেছে নিয়েছে। নিজেদেরকে নিকৃষ্ট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে এবং সর্বত্র ঘৃণার পাত্র হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। তাদের ঘৃণিত অপরাধের জন্য এবং সাধারণ মানুষকে ব্যবহার করে ক্ষতিসাধন করার জন্য বিচারের মুখামুখি করতে আমরা পার্বত্য বাসী সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিকট বিনীত অনুরোধ করছি। ভারত মায়ানমার ও বাংলাদেশ এই তিনটি দেশের ত্রিদেশীয় সীমান্ত এলাকা হচ্ছে বান্দরবান৷ জেলার দুর্গম এলাকার যোগাযোগ বিহীন অরণ্যকে তারা তাদের থাকার আবাসন হিসেবে বেছে নিয়েছে৷ ছোট্ট ছোট্ট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে চাঁদা আদায় করছে৷ তাদের এই হয়রানি থেকে বাঁচতে সাধারণ মানুষ আইন- শৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতা করতে মুখিয়ে আছে। যারা তাদের চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বাধা হচ্ছে তাদেরকে বেছে বেছে তারা হত্যা করছে৷ ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস সংক্ষেপে আইইডি পুঁতে রেখে জুয়েল ত্রিপুরাকে হত্যা করেছে এবং সেনাদেরও হত্যা করেছে। তারা চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা সহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীকে ঘৃণা করে। এতটা সাম্প্রদায়িকতা লালন করে যা শান্তি বিনষ্টের শামিল। এদের এই রাষ্ট্র বিরোধী তৎপরতা আমরা সাধারণ পাহাড়ি বাঙ্গালী মেনে নেব না। তাদের সমুচিত জবাব দিতে সদা আমরা প্রস্তুত। অগণিত পাহাড়ি-বাঙ্গালী হত্যা ও সেনা হত্যা এবং পাহাড়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করার অভিযোগে কেএনএফ সন্ত্রাসীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। তাদের বিচারের মুখামুখি করতে ব্যর্থ হলে পরবর্তীতে অন্যান্য জাতি হইতে পাহাড়ে উক্ত ঘটনাগুলো করতে উৎসাহ পাবে। তাই সমূলে এই বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদের দমনে আমরা সরকারের কঠোর পদক্ষেপ চাই।

তার আগে এই বিচ্ছিন্নতাবাদী কেএনএফ এর উত্থান সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক-

কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) ও কেএনডি এর সভাপতি হচ্ছেন- নাথানা লনচেও প্রকাশ নাথান বম (৪৫)। বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার ২ নং রুমা সদর ইউনিয়নের ইডেন পাড়ার বাসিন্দা মৃত জাওতন লনচেও (জুমচাষী) এর পুত্র হচ্ছেন এই নাথান বম। তার মাতা মৃত রৌকিল বম, ছিলেন একজন গৃহিনী। একটি হতদরিদ্র পরিবার থেকে তার উঠে আসা বলা যায়।

কেএনডি গঠন সম্পর্কে জানা যায়, আনুমানিক ২০০৮ সালে তিনি নিজস্ব বম জাতিসহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্বার উন্নয়ন কল্পে বাংলাদেশ সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবি পেশ করেন।
এ প্রেক্ষাপটে তিনি নিজেকে সভাপতি করে রুমা উপজেলা সদরে কেএনডি ও কুকি- চিন ন্যাশনাল ডেভলোপমেন্ট অরগানাইজেশন) নামে সমাজ কল্যানণমুলক একটি সেন্ট্রাল প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। পরবর্তীতে, গত ২৮ জুন ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে রুমা উপজেলা সমাজ সেবা অধিদপ্তর থেকে স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন নামে রেজিসট্রেশন করেন।

কেএনএফ গঠন সম্পর্কে জানা যায়, ২০১৭ সালে নাথান বম নিজকে সভাপতি করে ধীরে ধীরে কেএনএফ নামে একটি সশস্ত্র দল/ সংগঠন গঠন করেন। এ সংগঠনের মূল লক্ষ্য উদ্দেশ্য পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্তবর্তী অঞ্চল সমূহের ৯ টি উপজেলা) নিয়ে একটি পৃথক রাষ্ট্র/ জৌ- ল্যান্ড গঠন করা। এজন্য নাথান বম আলাদা রাষ্ট্রের খসড়া মানচিত্র প্রকাশ করে এবং রাষ্ট্রকে হুমকি প্রদর্শনের জন্য বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সশস্ত্র মহড়ার ভিডিও শেয়ার করে নিজেদের শক্তিসামর্থ্য জানান দিতেন।

কুকি চিন জাতি কী তা পাঠকের জ্ঞাতার্থে সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করছি-
কুকিরা চীন, তিব্বত ও মঙ্গোলিয়া হইতে আগমণ করে মিয়ানমারের চীন প্রদেশের চীনা পাহাড়ে বসতিস্থাপন করে। প্রবাদে আছে কুকিরা মোঙ্গোলীয় মহাজাতির একটি শাখা। কুকি মূলত কোন একক নৃগোষ্ঠী নয়। প্রায় ৫০ টি জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে কুকি-চিন-মিজো জাতি গঠিত। এদের অধিকাংশ জাতিগোষ্ঠী মিয়ানমারের চিন রাজ্যে বসবাস করে। এদের বড় একটি নৃগোষ্ঠী ভারতের মিজোরাম রাজ্যে মিজো জাতি যারা বাংলাদেশে বম, লুসাই, খুমি, চাক ও পাংখোয়া নামে পরিচিত‌। এই জাতিগোষ্ঠীর একটি অংশ মিয়ানমার ও ভারতে থাডো নামে পরিচিত। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের চেয়ে ভারতের মিজোরাম জেলায় কুকি জো জাতির বসবাস বেশি। বাংলাদেশের বান্দরবান সদর, রুমা, রোয়াংছড়ি, বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি, বরকল অঞ্চলে এদের বেশি বসবাস রয়েছে। এসব জাতিসত্তা নিজেদের বলে ‘জো’।
কেএনএফ সংগঠন সবগুলো কুকি চিন জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে দাবি করলে আসলেও মূলত তারা শুধুমাত্র বম সম্প্রদায় থেকে। খুমি, চাক, লুসাই, পাংখোয়া জনগোষ্ঠী হইতে কেএনএফ এর সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই বলে সংবাদ সম্মেলন করে তাদের প্রতিনিধিরা জানায়।

কেএনএফ কর্তৃক জঙ্গি গোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ তাদের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে গত ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে সাধারণ পাহাড়ীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিশেষ অভিযানে নামে যৌথবাহিনী৷ এই অভিযান থেকে বাঁচতে তারা চোরাগোপ্তা হামলার পথ বেছে নেয়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেএনএফ সন্ত্রাসীদের সশস্ত্র ভিডিও প্রচার এবং কুকি-চিন রাজ্য গঠন করার দাবির পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে আসে। অভিযোগ আসে কেএনএফ একটি জঙ্গি গোষ্ঠীকে আশ্রয়-প্রশয় দিয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। যার কারণে সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এর বিরুদ্ধে অপারেশনে নামে। সেনা অভিযান ঠেকাতে তারা জনসাধারণকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এবং চোরাগোপ্তা হামলার পথ বেছে নেয়।
তাদের হামলায় গত ১২ মার্চ মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন শহীদ হন। গত ১৬ মে এর হামলায় সেনাবাহিনীর দুইজন সৈনিকের মৃত্যু হয়েছে। শহীদ সৈনিকরা হলেন, মো. আলতাফ আহম্মদ ও মো. তৌহিদ। এর গত ১ জুলাই তোজাম নামের আরেক সৈনিককে হত্যা করে! এভাবে সন্ত্রাসীরা সেনাদের হত্যা করে যাচ্ছে। অবশ্যই এই হত্যার বদলা নেওয়া হবে। শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেবো না৷ পার্বত্যবাসী এর প্রতিশোধ অবশ্যই নেবে।

সাধারণ মানুষের জানমাল রক্ষায় এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সেনাবাহিনী অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে কেএনএফ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিবে বলে আমরা আশাবাদী। সচেতন নাগরিক হিসেবে সরকারের নিকট দাবি পাহাড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার অংশ হিসেবে সেনাক্যাম্প বৃদ্ধি করা হোক।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More