আঞ্চলিকদল ও সিন্ডিকেটকে চাঁদা দিয়ে প্রকাশ্যে পাচার হচ্ছে বিলুপ্ত পাহাড়ি গাছগাছালি।

0

বন ও পরিবেশ আইন অমান্য করে প্রতিদিনই পাচার হচ্ছে অবৈধ সেগুন-গামারির গাছ ও চিরাই কাঠ। এছাড়াও ইটভাটার জ্বালানি কাঠ হিসেবে পাহাড়ের বিলুপ্ত গাছগাছালি ধ্বংস করা হচ্ছে। প্রতিদিন সন্ধ্যা নামলেই কাউখালী উপজেলা সদর সড়ক ও বেতছড়ি সড়ক হয়ে শতাধিক জ্বালানি লাকড়ি বোঝাই ট্রাক ও জীপ (চান্দের গাড়ি) যায় রানিরাহাট রাঙ্গুনিয়ার দুই শতাধিকের উপর ইটভাটায়৷ এমনকি দিবালোকে অবৈধভাবে সেগুন-গামারি কাঠ পাচার হচ্ছে সবার নাগালের মধ্য দিয়ে। কাঠ চোরাকারবারিরা কাউখালীর করাতকল (স.মিল) গুলোতে মজবুত করেছে বিপুল পরিমাণ কাঠ। অনেকেই পারমিটের স্টকস্থলের পরিবর্তে করাতকলের পাশে স্টক করেছে অবৈধ কাঠ পারমিটে ঢুকানোর জন্য। কাউখালীর বেশির ভাগ পারমিটের বাগানে গাছ নেই৷ অন্যান্য বাগান থেকে বন কর্মকর্তার যোগসাজশে পারমিটে গাছ ঢুকানো হচ্ছে। এর ফলে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে নানান প্রশ্ন তৈরি হয়েছে৷ চরমভাবে ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে।

উপজেলার তালুকদার পাড়া-ঘিলাছড়ি হতেই কাঠগুলো নিয়ে আসা হয় কচুখালী থুইমং মারমার করাতকলের মাঠে এবং সেখান থেকে পরবর্তীতে রানিরহাটের বিভিন্ন করাতকলে।

পাহাড়, প্রকৃতি, বনাঞ্চল উজাড় করে যাচ্ছে নিষিদ্ধ গোলকাঠ ও ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে পাহাড়ি বিলুপ্ত গাছগাছালি৷ পরিবেশ আইন ও বন আইন অমান্য করে পাহাড়গুলো মরুভূমি করার মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য ও পাহাড়ের প্রকৃতি ধ্বংস করা হচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্যের ক্ষতিসাধন করা হয়। সেসাথেই পাহাড় ধ্বসের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে কাঠ চোরাকারবারিরা। আঞ্চলিক সন্ত্রাসী দলগুলো কাঠ ও জ্বালানি লাকড়ি থেকে আদায় করা বিপুল পরিমাণ চাঁদার টাকা দিয়েই অবৈধ অস্ত্রক্রয় করে রাষ্ট্র ও বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, তথাকথিত কাঠ সমিতি প্রতিটি কাঠের গাড়ি হইতে ১২০০ টাকা থেকে ৪০০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করে৷ আদায়কৃত চাঁদার টাকা সম্পূর্ণ চাঁদার রশিদে না তুলে মাত্র ১৫০ টাকা সড়ক সংস্কারের নামে তোলা হয়। এমনটা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ। কোন আইনে সড়ক সংস্কারের নামে টাকা তোলে তা কোনভাবেই বোধগম্য নয়। সূত্রগুলো বলছে, চাঁদার বাকী টাকা তাদের পকেটসহ ইউপিডিএফ-এর হাতে চলে যায়। এই সিন্ডিকেট অনেক শক্তিশালী। মাফিয়া সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে বিভিন্ন মহলের। সূত্রে জানা যায়, ইউপিডিএফ-জেএসএস-এর সম্পৃক্ততায় অবৈধ কাঠ ও ইটভাটার জ্বালানি পাচার হচ্ছে। কাঠ চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে গুম-খুনসহ বড়ধরণের হয়রানির শিকার হতে হয়। তাই সবাই ভয়ে চুপ থাকে। কাঠ সমিতির এই সিন্ডিকেটকে মোটা অংকে চাঁদা দেয়া ছাড়াই কোনপ্রকার কাঠ নেওয়া যায় না। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে- মানুষ ঘরের জন্য একটুকরো কাঠ নিলে তা আটক করা হয় কিন্তু কাঠ চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কেনা-বেচা এবং পাচার করলে তা আটক করা হয়না। প্রকাশ্যে দিবালোকে অবৈধ গোলকাঠ ও চিরাই কাঠ পাচার হয়। প্রকাশ্যো সড়কে দাঁড়িয়ে অবৈধ কাঠের লাইন পরিচালনা করে কাঠ চোরাকারবারি সিন্ডিকেট বা তথাকথিত কাঠ সমিতি। সিন্ডিকেটের প্রভাবশালী জনৈক ব্যক্তি সমিতির দীর্ঘদিন দ্বায়িত্বে থেকে কয়েকশো কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। এখন জায়গা জায়গাতে রয়েছে তার সম্পত্তি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। অথচ একসময় সে ছিল মানুষের কামলা! সে জনেক ব্যক্তি ১৯৭৯ সনের বাঙ্গালীও নয়। পার্বত্য চুক্তির পরেই পাহাড়ে আজ সে মাফিয়া। এখন সে অবৈধ কাঠ থেকে চাঁদা তোলে কোটিপতি। কাউখালীতে রয়েছে তার দোকান এবং বাসায় রয়েছে কারখানা এবং চট্টগ্রাম হালিশহর রয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

কাঠ ও জ্বালানি লাকড়ি পাচারের কাউখালী উপজেলার সড়ক পথগুলো-

উল্টোপাড়া-তালুকদারপাড়া থেকে কচুখালী হয়ে উপজেলা সদর সড়ক দিয়ে কাঠ ও জ্বালানি লাকড়ির গাড়ি প্রতিদিন রাত্রেই যাচ্ছে নির্বিঘ্নে৷ বটতলী-কাশখালী হইতে প্রতিদিন উপজেলা সদর হইয়ে যাচ্ছে এসব অবৈধ কাঠ ও জ্বালানি বোঝাই গাড়ি৷ চেলাছড়া, যৌথখামার থেকে কাউখালী বেতছড়ি সড়ক হয়েও যাচ্ছে এছাড়াও নাইল্যাছড়ি, তারাবুনিয়া এবং বেতবুনিয়া থেকেও যাচ্ছে। ২৫৩টি ইটভাটার জ্বালানি লাকড়ি যায় কাউখালী উপজেলা হইতে। রাত্রে প্রায় শতাধিক কাঠ-লাকড়ি বোঝাই গাড়ি যায়। এখানে সংরক্ষিত বনাঞ্চল না থাকলেও এই বিটের চারা গাছপালা, বৃক্ষরাজি, বিলুপ্ত গাছগাছালি সব কেটে শেষ করে ফেলছে কাশঁখালী রেঞ্জের বনকর্তার যোগসাজশে। যদি বন কর্মকর্তার যোগসাজশ না থাকে অবৈধ কাঠ যত্রতত্র পড়ে থাকে কীভাবে? এবং কাঠ বা জ্বালানি লাকড়ি পাচার হয় কীভাবে?

স্থানীয়দের অভিযোগ বেপরোয়া গতির অবৈধ কাঠ-লাকড়ির গাড়ি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করার যেনো কেউ নেই৷ সড়ক দিয়ে হেটে যাওয়া যায়না। যেমন হয় শব্দ দূষণ তেমনি হয় সড়কের বেহাল অবস্থা।

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জানান, আমরা ছোটখাটো ব্যবসায়ী কাঠ নিলে ধরা হয় কিন্তু বড় ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন মাধ্যমকে ম্যানেজ করে কাঠ নেয় তাই তাদের কাঠ ধরা হয়না। সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কাছে আমরা ছোট ব্যবসায়ীরা অসহায়। তবে বর্তমানে যেভাবেই অবৈধ কাঠ ও জ্বালানি লাকড়ি যাচ্ছে তা এভাবেই প্রকাশ্যে কখনো যায়নি। বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে দিবালোকে নিচ্ছে। এখন কাঠ নিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা কোন সংস্থার ভয়-বাধা নেই। তাদের সামনে দিয়ে কাঠ যায়। তাদেরকে ম্যানেজ করার লোক রয়েছে।

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এলাকার জনৈক ব্যক্তি জানান, এখন কাঠ ধরার জন্য তথ্য প্রশাসনকে যারা দেয় তাদের পরিচয় ফাঁস করে দেওয়াসহ হয়রানি করা হয়। তাই কেউ অবৈধ কাঠের বিরুদ্ধে কথা বলেনা। অথচ অবৈধ কাঠ ব্যবসায়ীরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা সম্পর্কে আগাম তথ্য আঞ্চলিক দলগুলোর কাছে সরবরাহ করে অভিযান বানচাল করেন। তবুও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবৈধ কাঠের বিরুদ্ধে অভিযান দিতে অনিহা। যদিও কেউ কেউ বলছে টাকা আর ফার্নিচার ফেলে সবাই খুশি৷ কিন্তু এই অবৈধ কাঠ যে আঞ্চলিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী গুলোর টিকে থাকার প্রধান চাঁদার উৎস তা কেউ বুঝতে চায়না।

স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, গুটিকয়েক অসাধু ব্যবসায়ীর জন্য রাষ্ট্র ও বাঙ্গালীরা বিরাট ক্ষতি সাধনের শিকার হচ্ছে। আমার মতে বন বিভাগ এভাবেই বছরের পর বছর কাঠ নিষিদ্ধ রেখেই চোরা পথে কাঠ পাচারের সুযোগ দিয়ে সাধারণ মানুষদের হয়রানি করছে। সবার পক্ষে জোত পারমিট করা সম্ভব নয়। সারা দেশে মানুষ গাছ লাগিয়ে নিজের চাহিদা মত গাছ কাটতে পারে কিন্তু পাহাড়ে গাছ লাগিয়ে চাহিদা মত কাটতে পারেনা বন বিভাগের পারমিটের নামে হয়রানির কারণে৷ চোরা পথে বন বিভাগ কাঠ পাচার করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিতে পারছে তাই বৈধ উপায়ে কাঠ কাটা বন্ধ রেখেছে অযাচিত নিয়ম করে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য অঞ্চলে অবৈধভাবে কাঠ পাচার হলেও কাউখালীর মত এত বেশি পরিমাণে প্রকাশ্যে দিবালোকে বিলুপ্তগাছগালি কেটে পাচার কোথাও হচ্ছে না। চাঁদার ভাগবাটোয়ারার কারণে অবৈধ কাঠ ধরা হয়না। এখানকার কাঠ ব্যবসায়ীদের মধ্যে অধিকাংশ ইউপিডিএফ এর বাঙ্গালী কালেক্টর এবং সোর্স হিসেবে নিয়োজিত থেকেই সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে।

পরিবেশবাদীরা বলছে এভাবে বনাঞ্চল উজাড় করে নিষিদ্ধ বিলুপ্ত পাহাড়ি গাছগাছালি কেটে ইটভাটার জন্য লাকড়ি এবং কাঠ পাচার করতে থাকলে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হবে৷ পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও পাহাড় ধসের ঝুঁকি কমাতে সংশ্লিষ্টদের উচিত অবৈধ কাঠ- জ্বালানি লাকড়ি পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
কাঠ পাচারে ক্ষতিকর দিকগুলো-
১. ইউপিডিএফ-জেএসএস এর চাঁদার প্রধান উৎস অবৈধ কাঠ-লাকড়ি এবং এই চাঁদাবাজির টাকার কারণে ইউপিডিএফ এর অর্থ ভান্ডার অনেক সমৃদ হচ্ছে।
২. অবৈধ কাঠ-লাকড়ি কাটতে গিয়ে কাঠ চোরাকারবারিরা বনাঞ্চল উজাড় করে পরিবেশের ক্ষতিসাধন করে।
৩. অতিরঞ্জিত বনাঞ্চল ধ্বংসের ফলে পাহাড় ধ্বসের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
৪. বন ও পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করার কারণে পরিবেশের ভারসাম্য হুমকির সম্মুখীন।
৫. কাঠ চোরাকারবারিরা অবৈধ কাঠ পাচার করতে গিয়ে সার্বক্ষণিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নজরদারিতে রাখে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আগাম তথ্য আঞ্চলিক সন্ত্রাসী দল কে সরবরাহ করে অভিযান বানচাল করার মাধ্যমে আঞ্চলিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে।
৬. অবৈধ কাঠ পাচারকারী বিশাল সিন্ডিকেট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম ভেঙ্গে দেয়।
৭. অবৈধ কাঠ পাচারকারীরা আঞ্চলিক দলগুলোর গণলাইনের সোর্স হিসেবে কাজ করেন।
৮. সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে।

বিলুপ্ত গাছগাছালি পাচার রোধে সরকার আইন করেও ব্যর্থ হচ্ছে তথাকথিত কাঠ ব্যবসায়ী সমিতি এবং ঘুসখোর কিছু বন কর্মকর্তা-কর্মচারীর কারণে। সংশ্লিষ্টরা একটু তৎপর হলেই কাঠ পাচার রোধ করা সম্ভব বলে মনে করে স্থানীয়রা।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More