আঞ্চলিক দলগুলোর বাধার কারণেই সম্পূর্ণ চুক্তি বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না।

0

পার্বত্য চুক্তি পক্ষ জেএসএস সন্তু ভেঙে একাধিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে সশস্ত্র সংঘাত এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত করার মাধ্যমে এ অঞ্চলে নিরাপত্তা সংকট তৈরি করেছে। তাদের এই বিভক্তির অন্যতম কারণ হিসেবে সচেতন মহল মনে করে, চাঁদাবাজির বিপুল পরিমাণ টাকা ভাগাভাগি এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বৈরী আচরণকারী বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বা আঞ্চলিক দল বা সংগঠনগুলো হচ্ছে- পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতি বা জেএসএস সন্তু (১৯৭২), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট ইউপিডিএফ প্রসিত (১৯৯৮), জেএসএস এম.এন লারমা (২০০৭, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক বর্মা (২০১৭), মগ লিবারেশন আর্মি (২০১৮), কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (২০২১ সালে গেরিলা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি দল বার্মার কাচিন থেকে রুমায় ফিরে আসে) ২০২২ সালে তারা আত্মগোপনে যায়। যদিও তারা বলে আসছেন তারা ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কেএনডি’র মাধ্যমে)।

উক্ত ৬টি আঞ্চলিক সন্ত্রাসী দলের অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি, খুন-গুম এবং দেশবিরোধী অপতৎপরতার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পূর্ণ বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো মনে করে পার্বত্য চুক্তি সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়ে গেলে পাহাড়ে তাদের রাজত্ব কায়েম বন্ধ হয়ে যাবে। তারা যে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে উপজাতি এবং বাঙ্গালীদের থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি করে সে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়ে যাবে চুক্তি বাস্তবায়ন হলে। তার জন্য সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো অস্ত্র ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে অনিহা।

পার্বত্য চুক্তিতে কী বলা আছে?

পার্বত্য চুক্তির ঘ খন্ডের (১৩) মোতাবেক, “সরকার ও জনসংহতি সমিতি যৌথভাবে এই চুক্তি স্বাক্ষরের ৪৫ দিনের মধ্যে অস্ত্র জমাদানের জন্য দিন, তারিখ ও স্থান নির্ধারণ করিবেন। জনসংহতি সমিতির তালিকাভুক্ত সদস্যদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমাদানের জন্য দিন তারিখ ও স্থান নির্ধারণ করার জন্য তালিকা অনুযায়ী জনসংহতি সমিতির সদস্য ও তাহাদের পরিবারবর্গের স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তনের জন্যে সব রকমের নিরাপত্তা প্রদান করা হইবে।

(১৪) নির্ধারিত তারিখে যে সকল সদস্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দিবেন সরকার তাহাদের প্রতি ক্ষমা ঘোষণা করিবেন। যাহাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা আছে সরকার ঐ সকল মামলা প্রত্যাহার করিয়া নিবেন। এসব ছিল চুক্তির মৌলিক শর্ত।

অপ্রিয় হলেও সত্য যে, জেএসএস এর কিছু সদস্য অস্ত্র জমা দিলেও বেশিভাগ সদস্য চুক্তির মৌলিক শর্ত লঙ্ঘন করে অবৈধ অস্ত্র নিয়ে আছে। ঠিক একইভাবে ইউপিডিএফ সহ অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলো চুক্তির পরও অবৈধ অস্ত্র নিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করছে। তাদের বাধার কারণেই সম্পূর্ণ চুক্তি বাস্তবায়নে সম্ভব হচ্ছে না। চুক্তির ২৬ তম বর্ষপূর্তিতে লক্ষণীয় ছিল, ইউপিডিএফ চুক্তির বিরুদ্ধে নানান ভাবে প্রতিবাদ করেছে এবং রাজপথে পর্যন্ত কর্মসূচী করেছে৷ এমন পরিস্থিতিতে চুক্তি সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন সরকার এবং জেএসএস এর জন্য এক কঠিন চ্যালেঞ্জ।

সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধি এবং নেতৃত্বকারী হিসেবে জেএসএস এককভাবে চুক্তি সম্পাদিত করলেও অন্যান্য গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় ভুক্ত আঞ্চলিক দলগুলো জেএসএস এর চুক্তি মানছেন না। ইউপিডিএফ চুক্তির ১ বছর পর ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর স্বায়ত্তশাসন দাবিসহ চুক্তির বিরোধিতা করে আত্মপ্রকাশ করে। তারা সরকারের নিকট বিভিন্ন আলাদা দাবিদাওয়া পেশ করেছে। ঠিক একভাবেই কুকি চিন ন্যাশলাল ফ্রন্ট আলাদা দাবিদাওয়া নিয়ে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছে। তাদের সঙ্গেও সরকারের আলাপ আলোচনা চলছে।

সরকার জেএসএস কে তাদের দাবিদাওয়া অনুযায়ী সবধরনের সুযোগ সুবিধা দিয়েও নিরস্ত্র করতে পারেনি। জেএসএস বরাবরই বলে আসছে সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন করছে না। কিন্তু সরকারি সূত্র গুলো বলছে চুক্তির প্রায় ৯০% বাস্তবায়ন করেছে সরকার৷ বাকী অবশিষ্ট অংশ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন। যা বাস্তবায়ন করতে জেএসএস এর সহযোগিতা প্রয়োজন। এবং জেএসএসকে সম্পূর্ণ অবৈধ অস্ত্র পরিহার করতে হবে৷ কিন্তু জেএসএস অস্ত্রবাজি ও চাঁদাবাজি ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চায়না এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের চুক্তি বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতেও ব্যর্থ হচ্ছে৷ জেএসএস এই ব্যর্থতার দায়ী কেন সরকার বহন করবে? পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে শুধু সরকারই নয় পার্বত্য জনসংহতি সমিতি বা জেএসএসও শর্ত মানতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু তাদের চুক্তির শর্ত মানার আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেকের।

১৩,২৯৫ বর্গ কিলোমিটারের পার্বত্য চট্টগ্রামের ৮/১০ লাখ উপজাতির সঙ্গে সরকার যদি ৩/৪টি চুক্তি সম্পাদিত করে তাহলে এর পরিণতি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে হয়তো পাঠকমহল পার্বত্য চুক্তির মধ্য দিয়ে তা অনুমান করেছেন। নতুন নতুন চুক্তির ফলে তাদের মধ্যে আরো বড়ধরণের জাতিগত সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে। উপজাতি সংগঠনগুলো স্বজাতির অধিকার বিষয়ে সৃষ্টি হলেও সবাই কিন্তু চাঁদাবাজি ও অস্ত্রবাজি হিসেবে সাইনবোর্ড ব্যবহার করছে। চাঁদাবাজিই তাদের মূল্য লক্ষ্য। চুক্তি হচ্ছে তাদের চাঁদাবাজি এবং রাজত্ব কায়েম করার পথ প্রসারিত করার হাতিয়ার। তথাকথিত অধিকার আদায়ের সংগঠনগুলোর মধ্যে অনৈক্য এবং দাবিদাওয়া নিয়ে বিরোধ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত। তাদের আন্তকোন্দলের বলি কেন বাঙ্গালী, সেনাবাহিনী বা রাষ্ট্র হবে?

চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে সরকারকে অভিযুক্ত করার আগে জেএসএস কে অন্যান্য আঞ্চলিকদল গুলোর সঙ্গে বসে বিরোধ নিরসনসহ অবৈধ অস্ত্র পরিহার করার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে হবে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More